বৌদ্ধকাহিনী ব্যতীত মৌর্য সম্রাট
অশোকের জীবনেতিহাস সম্বন্ধে জানা যায় তাঁর নিজের শিলালেখগুলি থেকে। এই শিলালেখগুলি অশোকের নির্দেশে, বহুলাংশে তাঁর নিজের ভাষায় রচিত হয়ে তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র পাথরের উপর উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। যুগে যুগে পুঁথি লেখকেরা পুঁথি নকলের সময়ে তাতে যেসকল পরিবর্তন যোগবিয়োগ ঘটাতেন কিন্তু অশোকের এই শিলালেখগুলি পাথরে উৎকীর্ণ হওয়ায় তাতে সেরূপ কোন পরিবর্তন হতে পারে না, সেগুলি অশোকের যুগে যেমন ছিল আজও সেরূপই আছে। ভারতীয় শিলালেখমালর ইতিহাসে অশোকের শিলালেখসমূহ এক স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে আছে। অশোকের লেখাগুলি
শিলাখন্ডে,
স্তম্ভগাত্রে এবং
গিরিগুহায় পাওয়া গেছে।
বাংলা অবিভক্ত
অসম,
তামিলনাড়ু ও
কেরল বাদে ভারতের প্রায় রাজ্যে সম্রাট অশোকের কোনো না কোনো শিলালেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই শিলা লেখাগুলি সাধারণত
প্রাকৃত ভাষায় ও
ব্রাহ্মী হরফে লিখিত। তবে সম্রাট অশোক উপমহাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় খরোষ্টী লিপি ব্যবহার করেছিলেন বল্খ অঞ্চলের প্রজাগণের সুবিধার জন্য অশোক
গ্রিক ভাষা ও
গ্রিক লিপিতে কয়েকটি শিলালেখ উৎকীর্ণ করেছিলেন। তাঁর কিছু কিছু শিলালেখে
আরেমাইক ভাষার ও ব্যবহার দেখা যায়।
 |
সারনাথ |
এই লেখগুলি অশোক প্রধানত: তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীগণ ও পুত্রপৌত্রদি বংশধরগণকে উদ্দেশ্য করে প্রচার করেছিলেন। তারা লেখগুলির বক্তব্য বিষয় জনসাধারণকে জানাবেন এটাও তাঁর নির্দেশ ছিল। লেখগুলির বহু স্থানে সম্রাট অশোক বলেছেন পাথরে উৎকীর্ণ করার পিছনে তাঁর আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, সেগুলি যেন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং তাঁর পুত্রপৌত্রপ্রপৌত্রগণ যেন প্রলয়কাল পর্যন্ত তা অনুসরণ করতে পারে। এই শিলালেখগুলিকে সম্রাট অশোক "
ধম্মলেখ" বলে অভিহিত করে ছিলেন। তাঁর রাজত্বের কোন বর্ষে কোন লেখ প্রচারিত হয়েছিল তার ও তিনি অধিকাংশ দেখতে উল্লেখ করেছেন। যেখানে সেরূপ উল্লেখ নেই সেখানে পূর্বের ও পরের কোন লেখ'র বর্ষ বা অন্য সংবাদ থেকে সময় নির্ণয় করা হয়।
অশোকের পূর্বে কোনো ভারতীয় রাজার পাথরে উৎকীর্ণ করে লেখ বা আজ্ঞা প্রচারের প্রমাণ নেই।ভারতীয় রাজারা চিরকালই
ভেরীধ্বনী প্রভৃতি সহকারে "
শ্রবক" বা ঘোষকের মুখে আজ্ঞা ঘোষণা করাতেন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্য সম্রাট অশোক ইরানের
হখামনিশীয় নৃপতিদের অনুকরণে এদেশে শিলালেখের মাধ্যমে রাজাজ্ঞা প্রচারের প্রদ্ধতি প্রবর্তন করেন। অশোকের সর্বপ্রথম ধর্ম ঘোষণাটিকে তিনি "
শ্রবণ" অভিহিত করেছিলেন অর্থাৎ যা শ্রবণ বা মুখে শুনানি হয়। সুতরাং তাদের অবশ্যই মৌখিক ঘোষণা করা হয়েছিল, পরে এই শ্রবণ টিকেও অশোক নানাস্থানে পুনরায় পাথরে উৎকীর্ণ করে প্রচার করাছিলেন। তার পরে তিনি আরও বহু যে সকল ঘোষণা প্রকাশ করেছিলেন, সেগুলি সবাই "ধর্মলেখ" রূপেই প্রথম থেকে পাথরে উৎকীর্ণ হত। কিন্তু পাথরে খোদাই করে লেখ প্রকাশ আরম্ভ করবার পরে ও যে সম্রাট অশোক মৌখিক ঘোষণা দ্বারা ও অনেক বাণী প্রচার করতেন তাঁর কয়েকটি দেখতে উৎকীর্ণ উল্লেখে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। (৬ষ্ঠ শিলালেখ এবং ৭ম স্তম্ভলেখ)
মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালেখগুলিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয় (ক)
চর্তুদশ প্রধান শিলালেখ : এগুলি সবই রাজত্বের ১৩ থেকে ১৪ বর্ষে প্রকাশিত হয়। প্রাপ্তিস্থান কালসী(উওরপ্রদেশ) গিরনার (কাথিয়াওয়াড়), মান্সেহরা (পাঞ্চাব), শাহবাজগড়ি (পাঞ্জাব), য়েরাগুডি (অন্ধ্র)। (খ)
ছয়টি স্তম্ভলেখ: প্রাপ্তিস্থান কান্দাহার (আফগানিস্তান)।(গ)
অপ্রধান শিলালেখ: এগুলি সম্রাট অশোকের বহু প্রাচীন শিলালেখ। প্রাপ্তিস্থান বাহাপুর (মহারাষ্ট্র) বৈরাট (রাজস্থান) মাসী (অন্ধ্রপ্রদেশ), পাথরে খোদাই করে রাজ্যজ্ঞ সম্রাট অশোকের পূর্বে ভারতে যদি অজ্ঞাত ছিল তবে সম্রাট অশোক তা আরম্ভ করলেন কেন ও কিরূপে, এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় প্রশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সাথেই ভারতের যোগ আলেকজান্ডারেরকে আরম্ভ করে মৌর্যযুগে বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়। প্রশ্চিম এশিয়ার বহুদেশে কয়েক সহস্র বৎসর পূর্বে থেকে রাজাদের ঘোষণা শিলালেখ প্রকাশ করা হত। মৌর্যযুগের পূর্বেই সমগ্র পশ্চিম এশিয়ার পারস্যদেশের সংস্কৃতি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে এবং উওর পশ্চিম ভারতের সঙ্গে এই সংস্কৃতির নিকট সংযোগ স্থাপিত হয়।পারস্য দেশীয় যোগ্য ব্যক্তিরা অনেকে যে অশোকের অধীনে কাজকর্মে নিযুক্ত হতেন তার ও প্রমাণ আছে। সুতরাং পারস্যের অনুকরণেই মৌর্য সম্রাট অশোক শিলালেখতে উৎকীর্ণ ঘোষণা প্রচার আরম্ভ করেন, এরূপ অনুমান অসঙ্গত নয়।
সম্রাট অশোকের শিলা লেখ গুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে সেকালের রাজার যুদ্ধ জয়, শাসন পরীচালনা, জনহিতকর বিভিন্ন কাজকর্ম, ধর্মীয় সামাজিক ব্যবস্থা, ইত্যাদি। পুরোনো দিনের ইতিহাস জানার জন্য লেখমালা, মুদ্রা, পাপ্ত বিভিন্ন ধরনের প্রন্ততাও্বিক উপাদান ও স্থাপত্য শিল্প অন্যতম হাতিয়ার।
 |
জুনাগড় |
 |
বিহার |
Comments
Post a Comment